একুশে ফেব্রুয়ারী: আমার দিন যাপনের শৈলী

২১শে ফেব্রুয়ারী (ফেব্রুয়ারী ২০১২)

অম্লান অভি
  • ১৩
  • 0
  • ৮৭
বাংলাদেশের উত্তরের একটি জেলা শহরে আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা। বালুবাড়ী মহল্লার ছোট্ট গলিকেন্দ্রিক পাড়ায় আমার বসবাস। গলিটির এক প্রান্তে ফুড অফিসের রাস্তা অন্যপ্রান্তে মিশন স্কুলের(নির্মল শিশু বিদ্যালয়) রাস্তা। ফুড অফিস ঘেষে একটি ক্লাব ‘সানফ্লাওয়ার’। এই সানফ্লাওয়ারই আমাদের অনেক কলিকে ফুলে পরিনত করেছে। ফুটবল, ক্রিকেট, দাবা, ব্যাডমিন্টন এই সব বিদেশী খেলার সাথে সাথে সাত ঘুটি, গুলি, ঘুড়ির সুতায় মানজা, দাঁড়িয়াবান্দা, মেয়েদের গোল্লাছুট খেলার সিজিনাল আড্ডা জমতো পাড়ার ছোট ছোট মাঠ গুলিতে বছর জুড়ে। সেই সাথে রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী, ঈদ-পুজা পূর্ণমিলনী, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস (তখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’এ ভূষিত হয়নি ২১শে ফেব্রুয়ারী), স্বাধিনতা দিবস আর উদীচি ও মৈত্রীর নববর্ষের অনুষ্ঠান ছিল আমার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঋদ্ধতার চারণাসর…….
আমার ছোট বেলা এক অফুরান সময় নিয়ে খেলা। সেখানে শখ ছিল, ঝোক ছিল, আনন্দ-উল্লাস ছিল, স্কুল ছিল আর স্কুল পালানোও ছিল। বছরের অনুষ্ঠান গুলো এক এক ধাপে সাজানো থাকতো আমার সমবয়সী প্রায় সবার মনের মাঝে। পাড়াময় একটা আনন্দ-উত্সব-প্রতিযোগিতা চলতো বছর জুড়ে। আমরা খুব কাছাকাছি থাকতাম নিজেদের মাঝে সবাইকে নিয়ে। বছরের যে যে পর্ব গুলো আমাদের একত্রিত করত অনেকটা বেশি সময় জুড়ে তার মধ্যে একুশে ফেব্রুয়ারী অন্যতম। আমরা মেতে থাকতাম রচনা প্রতিযোগিতা, দেয়ালিকা, রিহার্সেল, প্রভাতফেরী আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন নিয়ে……..
ফেব্রুয়ারীর শুরু থেকেই শুরু হয়ে যেত রিহার্সেল চলত একুশের আগের রাত অবধি। রুমিভাই লিড ভোকাল, পিয়াআপা কবিতার উচ্চারণ আর সবাই সেই প্রাণের গানে কন্ঠ দেয়া। ফেব্রুয়ারীর এই কয়েকটা দিন আমার মাঠ সাথীদের সাথে বিচ্ছিন্নতা। বৈরিতার কারণ বিবিধ- বিকেলে রিহার্সেল তাই মাঠ অবসর, রিহার্সেলে চা-চক্র ও বড়দের সাথে ঘনিষ্ঠতা আর প্রভাতফেরীতে গরুর গাড়ীর আসন না পাওয়ার ঈর্শা…….
আবুভাই মাঠের প্রশিক্ষক; বেলা গড়িয়ে গেলে সেও এসে রিহার্সেলে যোগদিত যদিও পাড়ার প্রায় সবাই কম-বেশী উপস্থিত হত সময়-অসময়ে তাদের সুবিধা মত রিহার্সেল থেকেই অনুষ্ঠানের আগাম স্বাদ নেবার। খোকনভাই গতবছরের একুশের সংকলন থেকে সারা বছর জুড়ে নির্বাচিত কবিতা আর প্রবন্ধের লাইন জোগান দিত পিয়া আপার হাতে। যে আমাকে পাঠ্য বইয়ের বাহিরের প্রথম কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ'কে পরিচয় করিয়েছিল বিচিত্রার পাতা থেকে আবৃতির উত্সাহ দিতে। রিহার্সেল জুড়ে প্রভাতফেরীর গান আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সব ঠিক হত। শেষ রিহার্সেলের দিন জানতে পারতাম গান, কবিতা, নাচ আর একাঙ্কীকার পর্ব বিন্যাস এবং পোষাকের বিবরণ (যদিও মেয়েরা আগে ভাগেই জেনে যেত শাড়ীর ধরণ)……..
বিশ ফেব্রুয়ারীর দিবাগত রাতটি ছিল আমার পাড়ার সমবয়সীদের মহা-আনন্দের, কারণ স্কুল বেলার প্রশয়যোগ্য রাত জাগার রাত(যদিও রাত জাগা হয়নি ক্লাস নাইন অবধি আমার বাড়ীর বাহির বন্ধু আসরে)। মধ্য রাত অবধি তৈরী হত শ্রদ্ধার্ঘ পুষ্পস্তবক যেখানে বেশ বড় করে লেখা থাকত ‘সানফ্লায়ার ক্লাব’ বালুবাড়ি। রাতেই গরুর গাড়ী আসত, মঙলু (মাইকওয়ালা) মাইক নিয়ে আসত, কালো ব্যাসের কাপড় কাটা হত, ব্যানারের বাঁশ ঠিক করা হত- সমস্ত জোগাড় ঠিক মত মিলিয়ে বড়রা আমাদের ঘুমাতে পাঠাত। আমরা সেই মধ্য রাতে রাত জাগার ইচ্ছাকে দমন করে ফিরে যেতাম যে যার ঘরে। দিনের ক্লান্তি চোখ জুড়ে ঘুম দিয়ে যেত অবলীলায়……..
ঘুম ভেঙ্গে আযানের ধ্বনির সাথে সাথে সমবেত হতেই দেখতাম পাড়ার মেয়েদের প্রায় সবাই সুযোগ বুঝে প্রভাতফেরীর গরুর গাড়ীতে কোরাসের উছিলায় আসন গেরেছে কিন্তু আমরা ছেলেরা সেই আসন প্রাপ্তির সংখ্যায় প্রায় শুণ্য! অপুভাই, গাবুদা আর আমি ছিলাম রুমিভাইয়ের কোরাসের সাথি। ছেলেদের গাড়ীতে সদস্য পদ খুব ক্ষণস্থায়ী ছিল, বছর ঘুরতে না ঘুরতে বাতিল হতো প্রায়। বড় হও সাথে সাথে হাটা সারির সদস্যে পরিনত হও, হাট প্রভাত ফেরীর গান গাও- বালুবাড়ি শহীদ মিনার, ডিগ্রী কলেজ হয়ে চেহেল গাজী মাজার যাও। আর তবলা বাজাতে অথবা কোন গানের লিড ভোকাল হলে আসন থাকা সম্ভব। তাই গানও শিখেছিলাম ছোড়দি’র কাছে। তবে পিয়া আপার সাথে সাথে উচ্চারণ করতাম ‘প্রভাতফেরী প্রভাতফেরী আমায় নিবে সঙ্গে’ অথবা ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ আর সেটাই আমাকে স্থায়ীত্ব দিয়েছিল প্রভাতফেরীর গরুর গাড়ীর আসনে। এক সময় যখন সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবী পড়ে খালি পায়ে প্রভাতফেরী সারিতে হাটতে ইচ্ছে হতো তখন দায়িত্ব আমাকে বসিয়ে রাখত গরুর গাড়ীতে মাইক্রোফোন হাতে………
প্রভাতফেরী শেষে আমরা যখন ফিরতাম তখন বেলা দ্বি-প্রহর। একটু অবসরের পরেই আবার শুরু হবে অন্য আয়োজন। সন্ধ্যাবেলা ফুড অফিসের মাঠে আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং রচনা প্রতিযোগিতার পুরস্কার ঘোষণা। সেই অনুষ্ঠান আমাকে ধাবিত করেছিল লেখায় আর গুরুগম্ভীর কণ্ঠে আবহ ধারাভাষ্যে রণো ভট্টাচার্য্যের প্রমিত উচ্চারণ অনুকরণে………..
সেই স্কুল বেলার শহীদ মিনার বানানোর মাটির কাজ দেয়া বুড়ি ম্যাডাম- পরীক্ষায় পাশের সাথে সাথে আমার অজান্তেই সংস্কৃতির বীজবপন করেছিলেন আমার সত্তায়। শ্রদ্ধায় অবনত হয় সেই সব আয়োজকদের জন্য যারা আমার স্কুল জীবনেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সামাজিকতার সাথে। অফুরান কচকচানি একুশ ঘিরে, যা আমাকে নয় বরং সেই সময় আমার সমবয়সীদের এক অনবদ্য বৈচিত্রময় সৌহার্দের শিখরে নিয়েছিল; যার ফলে আমরা হয়েছি এক পরিবারের সদস্যের মত একে অপরের পরিপোষক-পরিপূরক চিন্তায়, মননে ও মানসিকতায়………
ইতাবসরে আমি বড় হয়ে গেলাম। স্কুল পেড়িয়ে কলেজের কড়া নাড়লাম। সেই সাথে পরিবর্তন হলো আমার আবাস স্থলের। আমি স্থায়ী হলাম অন্য এক শহরে পিতার হাত ধরে আমার পূর্ব পুরুষের ভিটায়। অন্য রকম একুশ পালন করতে শিখলাম। কলেজ বন্ধুদের সাথে সংকলন প্রকাশ করলাম, কবিতা ফ্লোডারে কবিতা লিখলাম। আর বড় বড় অনুষ্ঠানে প্রতিযোগিতায় নাম লিখালাম। সঞ্চালকের ভূমিকায় নিজেকে দাড় করালাম জেলার মঞ্চে মঞ্চে। সেই একুশের জীবনও স্থায়ীত্ব পেল না…………
উচ্চ শিক্ষাকে সারথি করে পারি দিলাম বিআইটি’তে। সেই একুশে হলে হলে পুষ্প-স্তবক বানানোর প্রতিযোগিতায় পাড়ার একুশের কথা মনে করিয়ে দিল। তবে প্রভাতফেরীর ও সম্মিলিত আয়োজনের শুন্যতায় শহীদ দিবসের শোকাচ্ছন্নতাকে প্রকোট করেও নানা অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন ভরিয়ে তুললাম………..
সব সংকলিত জীবনের বন্ধন ছিন্ন করা চাকরীজীবি একুশে এসে প্রভাতফেরীতে না হাঁটতে পারা একুশ’কে পেলাম ‘অবসর পাঠ চক্র’র আমন্ত্রণে। চাদমারী থেকে শহীদ মিনার ঘুরে এসেও আমি দায়িত্বহীন প্রভাতফেরীর হাঁটার স্বাদ পেলাম না……..
আমার সেই স্মৃতিময় স্কুলজীবনের একুশ হল অতীত আর আমি চললাম আবহসঙ্গীতের সুরে- ‘পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায়’! সারিবদ্ধভাবে খালি পায়ে হাটতে হাটতে মন ও মুখে উচ্চারণ-‘একুশে ফেব্রুয়ারী আমি কি ভুলিতে পারি’ কী বিনম্রতায়! এখনও প্রভাতফেরী হয়, হয় নানা অনুষ্ঠান তবে সেই নিখাদ সৌহার্দ্যের ছোঁয়া পাই না আমার ফেলে আসা জীবনের মত করে। এমন করে স্মৃতির কচর কচর করলে সবাই বলবে আধিখ্যেতা….তবু সেই আধিখ্যেতাই আমার ছেলেবেলার একুশে ফেব্রুয়ারী- আমার স্বপ্ন জীবনের রঙিন প্রান্তর, বলা না বলা শব্দ ভান্ডার, ঐ আমার দিন যাপনের শৈলী।।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মামুন ম. আজিজ বেশ বাক্যগঠনে সুন্দর স্মৃতিচারণ। নিয়মিত লিখবেন আশা করছি এখানে।
ভালো লাগেনি ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
সূর্য অনেক দিন পর আপনার লেখা পরে স্মৃতিকাতর বিহবলতায় ডুবে গেলাম। সেই ছোট বেলার রিহার্সেল...... আট ঐ ফাল্গুনের কথা আমরা ভুলি নাই/ ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায় অথবা প্রভাত ফেরীতে আমরা কারা শান্তির পায়রা, রাষ্ট্রভাষা রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই স্লোগানে গলা ফাটানো আওয়াজ তুলে যেন মিশে যেতাম রফিক, জব্বার আর বরকতের কাতারে। সেই স্নিগ্ধ ছেলেবেলা আর পাওয়া হবে না কখনো। হয়ত আমার সন্তান এর দেখা কোন কালেই পাবে না। তাদের জন্য এই লেখা, স্মৃতিচারণ অবাক হয়ে পড়ায় সীমাবদ্ধ থেকে যাবে.............. খুব কষ্ট হয় কিছু করতে না পারার অক্ষমতায়। তবুও হৃদয়ে যে আন্দোলন লুকিয়ে আছে তার থেকে কী মুক্ত হতে পারবো?.................... ☼
ভালো লাগেনি ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
সেলিনা ইসলাম স্বাগতম ..!. এ এক জীবন্ত স্মৃতি মুখোরিত অন্যোন্য অধ্যায় ...বেশ সুনিপুনভাবেই গল্পে এঁকেছেন খুব ভাল লাগল । আগামীতে আরো লেখা পাবার প্রত্যাশায় শুভেচ্ছা ও শুভকামনা
ভালো লাগেনি ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
Lutful Bari Panna আপনার স্মৃতিচারণটি অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। তবে নীরবে বয়ে চলা এক শান্তু আবেগের ধারা লুকানো আছে লেখাটায়। ভাললাগার একটা শান্ত সরোবরে ডুবিয়ে দেয়। তবে আমি বোধ হয় আপনার চেয়ে একটু ভাগ্যবান। কারণ সংগঠনের সাথে এখনো গাটছড়া আছে। বেশ ভালভাবেই।
ভালো লাগেনি ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
জসীম মেহবুব অনেক মনোযোগ দিয়ে গল্পটা পরলাম আপনার । মনে হচ্ছে গল্পটি আপনার নিজের জীবন থেকেই নেয়া । সুন্দর গল্প হয়েছে ।
ভালো লাগেনি ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি sriti jorito lekhati onoboddo valo laglo.....Ovi k dhonnobad,,,,,,,
ভালো লাগেনি ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
sakil sritcharon mulok lekha onek valo legeche . sundor lekhar jonno onek dhonybad
ভালো লাগেনি ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
আনিসুর রহমান মানিক ভালো লাগলো /
ভালো লাগেনি ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
রোদের ছায়া একুশ নিয়ে সুন্দর , সাবলীল স্মৃতিচারণ করেছেন ......অনেক ভালো /
ভালো লাগেনি ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১২
নিলাঞ্জনা নীল অনেক আবেগময় স্মৃতিচারণ...
ভালো লাগেনি ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

১৩ সেপ্টেম্বর - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪